ইদানীং আত্মহত্যা নামক ব্যাধিটি সমাজে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো একটা আত্মহত্যার ঘটনা চোখে পড়ছেই। অবশ্য আত্মহত্যার পেছনের কারণ যে অভিন্ন তা কিন্তু নয়। তবে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো আজকাল অতি সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করেও এমন ঘটনা ঘটছে।

মানুষ সামাজিক জীব। বিভিন্ন প্রয়োজনে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মানুষকে সমাজের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হয়, লেনদেন করতে হয়, ওঠবস করতে হয়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যাটা এ জায়গায়ই। নিজের জীবনের বিভিন্ন ব্যর্থতা, লোকলজ্জার ভয়, মানুষের অবমূল্যায়ন কিংবা রোগ-শোকের তীব্রতায় অনেকেই এ ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তটি নিয়ে বসে।

তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিটি উপরোক্ত সব ধরনের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই কিন্তু সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসাবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়টি যখন তাকে বারবার পীড়া দিতে থাকে তখন সে প্রথমত পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকে, ইতিবাচক কোনো দিক না পেয়ে অবশেষে সে মনে মনে ভাবে ‘এত কষ্ট নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কী সার্থকতা?

হৃদয়ে এত অশান্তি পুষে বেঁচে থাকার তো কোনো মানে হয় না!’ সুতরাং এ জীবন নামক প্রদীপটিকে নিভিয়ে দিলেই সব ঝামেলা চুকে যাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-আসলেই কি সব ঝামেলা চুকে যাবে এ আত্মহত্যায়? না! এ যেন নিজ হাতেই মহাসংকটের নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন। কারণ আত্মহত্যা সম্পর্কে হাদিসে কঠিন ধমকি এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-অর্থ : যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করেছে সেও জাহান্নামের মধ্যে সর্বদা ওইভাবে নিজ হাতে বিষপান করতে থাকবে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে। (তিরমিজি শরিফ।)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শা ইত্যাদির আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে, দোজখেও সে সেভাবে নিজেকে শাস্তি দেবে। [তবে ইমান থাকা অবস্থায় মারা গেলে পাপের শাস্তি শেষে আল্লাহতায়ালা চাইলে মুক্তি দেবেন]।

বস্তুত পরকালীন দীর্ঘমেয়াদি কঠোর শাস্তির তুলনায় পার্থিব জীবনের দুঃখ-ক্লেশ অতি নগণ্য। তাহলে সামান্য কষ্টের বিপরীতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তিকে ডেকে আনা কি কখনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে?

আসলে এ প্রশ্নের উত্তরেই বেরিয়ে আসে আত্মহত্যার নেপথ্য কারণ। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, যারা আত্মহত্যা করছে তাদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো শিক্ষা নেই। থাকলেও অপ্রতুল। একজন ধার্মিক মানুষ সর্বক্ষেত্রে পরকালীন জীবনকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দেয়। সে পার্থিব জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করতে শেখে। সে উপলব্ধি করতে শেখে, মানব সৃষ্টি কেবল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য এবং ইহ-জাগতিক সব বিষয়-আসয় হলো গৌণ।

ধর্ম মানুষকে দুনিয়ার অসারতা অনুধাবন করতে শেখায়। সুতরাং পার্থিব কোনো জটিলতায় কিংবা সংকটে ধার্মিক ব্যক্তি পরকালীন জীবনের ভাবনায় সান্ত্বনা খুঁজে পায় এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে যার অন্তরে জড়বাদী চিন্তা জেঁকে বসেছে কিংবা স্রষ্টায় অনাস্থা যাকে পেয়ে বসেছে; সে জীবনের যে কোনো পদস্খলনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং মারাত্মকভাবে অবসন্ন হয়ে পড়ে।

এতে অনেকেই তার শুদ্ধ চিন্তাশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে এবং সর্বশেষ ফায়সালা হিসাবে সে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর ও গর্হিত কাজটাকে বেছে নেয়। পরকালীন অনন্ত জীবনের পরিণাম সম্পর্কে ভাবার সুযোগ আর তার হয়ে ওঠে না।

যেহেতু আত্মহত্যার প্রবণতা আগের থেকে বহুগুণে বেড়েছে সেহেতু এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়, ধার্মিক লোকের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। আচ্ছা তাহলে ধার্মিক লোকের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণটা কী?

এর উত্তরটা অনেক সহজ এবং অনেক হতাশাব্যঞ্জক। সমাজে যে বিভিন্ন উপায়ে জড়বাদী চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এটা বোঝার জন্য বোধকরি কোনো দার্শনিক হওয়ার প্রয়োজন নেই। নিজের চারপাশে চোখ ফিরালে সহজেই উপলব্ধি হবে এর বাস্তবতা।

গল্প-উপন্যাসের পাতায় কিংবা চলচ্চিত্রের কাহিনিগুলোতে দেখানো হচ্ছে পার্থিব সফলতার পেছনে একজন মানুষের কত ক্লেশ, কত ত্যাগ, কত কৌশল। ব্যর্থতার সে কি ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া! খেল-তামাশার সংবাদগুলো মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে কৃত্রিমতার ফানুস উড়িয়ে কিংবা হতাশার কালো মেঘ জমিয়ে। এর প্রভাবও পড়ছে বেশ।

বিশেষত তারুণ্যের মাঝে। প্রিয় দল বা খেলোয়াড়ের আনন্দ-বেদনা তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে, অস্বাভাবিক সব কাণ্ড ঘটিয়ে বসছে। এভাবে সে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ছে জড়সভ্যতার মরিচি মায়াজালে।

এ থেকে ফিরে আসা যেন অসম্ভব প্রায়। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ধর্মকে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তদস্থলে জড়সভ্যতার মেকি সফলতার প্রতি আকৃষ্টকারী বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত করা হচ্ছে।

এসব কারণে অতি সহজেই নতুন প্রজন্মের বড় একটি অংশ ধর্মহীন হয়ে পড়ছে এবং ‘দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও দাও ফুর্তি করো’ জাতীয় শিরোনামকে ধারণ করে নিজের জীবনের দৈনন্দিন কার্যক্রম সাজাচ্ছে। আর ব্যর্থতায় অধীর হয়ে নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহত্যার মতো চরম ঘৃণ্য ধ্বংসের দিকে!

এ পরিস্থিতিসহ সব সংকট থেকে উত্তোলনের একমাত্র উপায় হলো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশিত পথ ইসলামের অনুসরণ। সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি ইসলামকেই মানতে হবে। যখন কোনো মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত পথে চলতে ব্রতী হবে তখন পার্থিব কোনো জটিলতা কিংবা সংকট চরম বিষণ্নতায় রূপ নিয়ে তার কাছে প্রকাশিত হবে না। বরং এর কোনো সুযোগই আর অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু জড়সভ্যতার পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা যেমন বহু শ্রমসাধ্য ব্যাপার এর চেয়েও কঠিন ব্যাপার হলো, ঘুণেধরা এ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।

রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষেই কেবল সম্ভব আত্মহত্যার সব উপকরণের মূলোৎপাটন। কিন্তু স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্রই যখন জড়বাদীদের পা-চাটা গোলাম তখন এ পুণ্যের সময় তাদের কোথায়? হ্যাঁ, তবে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা যে একেবারে নিষ্ফল তা কিন্তু নয়। তাই আসুন নিজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি অন্যকেও আহ্বান জানাই প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এ শাশ্বত সত্যের ধর্মে।

আহ্বান জানাই পার্থিব সব কিছুর ওপর পরকালীন ভাবনাকে স্থান দিতে। আপনার-আমার প্রচেষ্টাতে হয়তো এমন কিছু মানুষ ফিরে আসবে যারা জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল। আর তাদের এ ফিরে আসা হবে আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

 

কলমকথা/বিসুলতানা